পরিচ্ছেদ ১৬.৪ : সড়ক দুর্ঘটনা

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় - বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার | NCTB BOOK

সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি
সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘটে থাকে। তবে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিস্থিতি ভয়াবহ। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এ সমস্যা নানামুখী আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এটি মানসিক সমস্যাকেও প্রভাবিত করছে। চালক, মালিক, ট্রাফিক পুলিশ এবং রাস্তার ত্রুটি ও দুর্বলতাজনিত সড়ককেন্দ্রিক যে দুর্ঘটনা তা-ই সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশে রাস্তাঘাট ও যানবাহন বৃদ্ধির সাথে সাথে দুর্ঘটনার হার অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ।

বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪,০৯১টি এবং ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,৯১৮টিতে। তাছাড়া ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যানবাহন দুর্ঘটনায় কবলিতদের মধ্যে মারা যায় ৫০.৫৮%, গুরুতর আহত হয় ৩৮.১০%, এবং সামান্য আহত হয় ১১.৩২% জন । গুরুতর আহতদের মধ্যে অনেকেই আবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়, যার কোনো পরিসংখ্যান নেই । প্রকৃতপক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি এরচেয়েও ভয়াবহ। দৈনিক খবরের কাগজে চোখ রাখলেই সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা অবহিত হতে পারব এবং জানতে পারব এ সমস্যার পেছনে রয়েছে বহু কারণ, যার প্রভাবও বহুমুখী ।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ
বাংলাদেশের শহরে গাড়ির সংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে হারে দক্ষ চালক তৈরি হয়নি। অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন চালককে দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। গাড়ি চালানোর জন্য যে সকল আইন ও নিয়মনীতি রয়েছে তাও অধিকাংশ গাড়ি চালকরা জানেন না। এ কারণে তারা কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে অনেকেই কম বেতনে সনদবিহীন চালক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এসব চালক অধিকাংশই তরুণ যারা রাস্তায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় অন্য গাড়িকে ওভারটেক করে এবং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে থাকে। এ কারণেও
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।

আমাদের দেশে অধিকাংশ ট্রাক চালক গাড়িতে পরিবহনসীমার অতিরিক্ত মাল বোঝাই করেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে খালি ট্রাকে যাত্রী বোঝাই করে গন্তব্যে পৌছান। শোভাযাত্রা, মিছিল এবং শিক্ষার্থীরা দলেবলে যাওয়ার জন্য ট্রাক ব্যবহার করে, যা অনেক সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়। আমাদের দেশে ট্রাক চালকদের একটি অংশ নেশায় আসক্ত। দূরপাল্লার পরিবহনে এসব চালকরা অনেক সময় নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালান। এ কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় দেখা যায় যাত্রী পরিবহনে আসন সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী, এমনকি গাড়ির ছাদেও যাত্রী বহন করা হয়। এর ফলে অনেক গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

অনেক সময় স্বল্পশিক্ষিত গাড়ির মালিকগণ অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশায় চালকদের হাতে চলাচলের অযোগ্য ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি তুলে দেন ৷ তাছাড়া হালকা বড়ির গাড়ি অনেক ক্ষেত্রে মহাসড়কে চলতে দেখা যায়। এ কারণেও দুর্ঘটনা বেড়ে যায় ।

কাজ-দলগত :সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রভিত্তিক কারণের একটি ছক তৈরি কর ।
চালক মালিক সড়ক সড়ক
       
       

আমরা অনেকেই সড়ক ব্যবহার করার নিয়মনীতি জানি না। রাস্তার কোন পাশ দিয়ে চলতে হবে, কখন পারাপার হতে হবে প্রভৃতি বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। উদাসীন ব্যক্তি, শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ অনেক সময় অসতর্কভাবে রাস্তায় চলাচল করেন। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে পথ চলেন। এরূপ নানাবিধ অন্যমনস্কতা ও অসতর্কতা অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটায় ।

রাস্তার উপর হাট-বাজার স্থাপন, নির্মাণসামগ্রী রাস্তায় রাখা, মহাসড়কে ধান, পাট, মরিচ শুকানো, গরু-ছাগল বেঁধে রাখা, একই রাস্তায় গাড়ি, অযান্ত্রিক যান এবং পথচারী চলাচল করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক পথচারীর জেব্রাক্রসিং এবং ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপার না হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।

চলন্ত অবস্থায় গাড়ি চালকের সাথে কথা বলা, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো, রাস্তায় গাড়ি বের করার পূর্বে যান্ত্রিক ত্রুটি পরীক্ষা না করা, সিটবেল্ট ও হেলমেট ব্যবহার না করা, অধিক রাতে গাড়ি চালানো এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারও কারও দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।

আমাদের দেশে কোনো কোনো সড়কের নক্সা এবং নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার এবং কন্ট্রাক্টরের কাজে উদাসীনতা এবং নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি এ সমস্যার জন্য দায়ী। ত্রুটিপূর্ণ সড়কের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব
সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে খুবই মারাত্মক, যা আবার বহু সমস্যার জন্ম দেয় । হাইওয়ে পুলিশ বিভাগের প্রকাশিত প্রতিবেদনের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের ২৪% লোকের বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ৩৯% লোকের বয়স ১৬-৫০ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা  কেন্দ্রের গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান শিকার হচ্ছে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত হওয়ার কারণে এসব পরিবারের সদস্যদের দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয় এবং আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ পরিবারের শিশুদের শিক্ষা ব্যাহত হয়।

কাজ-একক:একটি শিশুর জীবনে সড়ক দুর্ঘটনা পরিবারিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে ?

কাজ-দলগত:‘সড়ক দুর্ঘটনা শুধু পারিবারিক জীবনকেই বিপর্যস্ত করে না আর্থ-সামাজিক ও মানসিক জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে।'- ব্যাখ্যা কর।

অনেক সময় দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তি শারীরিকভাবে পঙ্গু হলে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, যা তার ব্যক্তি জীবনকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। মানসিক ভারসাম্যহীনতা ব্যক্তি জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এ সমস্যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যায় রূপ নেয়। আবার দেখা যায় পঙ্গু ব্যক্তিটিকে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা গ্রহণ করতে। কেউ কেউ জীবন নির্বাহের জন্য অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। চরম হতাশা লাঘবে অনেকে আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু ব্যক্তির পারিবারিক জীবনকেই বিপর্যস্ত করে না, আর্থ-সামাজিক ও মানসিক জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে।

সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাংচুর, সড়ক অবরোধসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অনেক সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চাকরিজীবীর কর্মঘণ্টা অপচয় হয়। পরিবহনের অভাবে কাঁচামাল নষ্ট হয়। গন্তব্যে মালপত্র পরিবহন বিলম্বিত হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটে। চিকিৎসাসহ জরুরি প্রয়োজন বাধাগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে আমরা প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকায় চোখ রাখলে আরও ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করতে পারব।

সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত রাখার উপায় এবং দুর্ঘটনা হ্রাসের পদক্ষেপ
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশেই কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে আমরা সড়ককে নিরাপদ ও দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে পারব।

  • চালক নিয়োগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ যোগ্যতা নির্ধারণপূর্বক নিয়োগ দেওয়া ;
  • গাড়ির চালককে ট্রাফিক আইন-কানুন ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালাতে উদ্বুদ্ধ করা এবং সাইড, সিগন্যাল, গতি মেনে সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে গাড়ি চালককে উৎসাহিত করা ;
  • বেপরোয়া ও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি না চালানো, গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল পরিবহন না করা, অন্য গাড়িকে ওভারটেকিং না করার বিষয়ে চালকদের সচেতন এবং আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করা ;
  • ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা;
  • সকল সিগন্যাল পয়েন্টে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল স্থাপন করা ;
  • আধুনিক ও মানসম্মত ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা ;
  • ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ সংস্কার ও পুননির্মাণ করে সড়ক নিরাপদ করার পদক্ষেপ গ্রহণ ;
  • গাড়ির ছাদে যাত্রী এবং মালপত্র বহন না করা;
  • প্রতিযোগিতা করে গাড়ি না চালানো ;
  • রাস্তায় গাড়ি বের করার পূর্বে যান্ত্রিক ত্রুটি পরীক্ষা করে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্ৰহণ;
  • আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দায়িত্ব পালনে সচেতন করা;
  • জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচার মাধ্যমকে ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করা ;
  • দূরপাল্লার সড়কের পাশে বাড়ি-ঘর তৈরি এবং হাট-বাজার স্থাপন না করা। তাছাড়া সড়কে ধান, পাট, মরিচ শুকাতে না দেওয়া এবং গরু-ছাগল না বাঁধা ;
  • ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দায়িত্বশীল হওয়া ; ভুয়া লাইসেন্সধারী কেউ যাতে রাস্তায় গাড়ি চালাতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দায়িত্বশীল করা ;
  • রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যালকোহল বা মাদক গ্রহণকারী গাড়ি চালকদের শনাক্ত করা এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাহার করা ।

নিরাপদ চলাচলের জন্য করণীয়-

  • ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা, দৌড়ে রাস্তা পার না হওয়া, চলন্ত গাড়িতে ওঠা-নামা না করা, চলন্ত অবস্থায় গাড়ি চালকের সঙ্গে কথা না বলা এবং জেব্রাক্রসিং, ওভারব্রিজ ও মাটির নিচের সংযোগ পথ তথা আন্ডার পাস দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া ;
  • শিশু-কিশোরদের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের মহাসড়ক, সংযোগ সড়ক ও আধাপাকা সড়ক সম্পর্কে পরিচিত করানো। তাছাড়া চলাচলের জেব্রাক্রসিং, পারাপার সেতু, ট্রাফিক পুলিশ, ফুটপাত, ট্রাফিক বাতি ও চিহ্নাবলি,বিপজ্জনক স্থান প্রভৃতি সম্পর্কে পরিচিত করানো;
  • ছোট ভাইবোনদের নিরাপদ চলাচল বিষয়ে আমরা সচেতন করব। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও প্রবীণদের নিরাপদ চলাচলে সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এমন পরিবারের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া কর্তব্য।
Content added By
Promotion